Skip to main content

ঙ্গবন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



ঙ্গবন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


ইকবাল মাহমুদ বাবলু
সিনেট সদস্য,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অসংখ্য গুণী সান্নিধ্যে ধন্য হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তির পর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে পূর্ববাংলার পশ্চাৎপদ মুসলিম জনগোষ্ঠীর উচ্চশিক্ষার আকর্ষণীয় মাধ্যম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকাকালে শেখ মুজিবুর রহমানের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ছাত্রলীগের নানা অনুষ্ঠান বা সাংগঠনিক আলোচনা সভায় তিনিই পালন করতেন মুখ্য ভূমিকা। সাংগঠনিক কাজে এক হল থেকে অন্য হলে তিনি যাতায়াত করতেন কলাভবনের নানা কাজে অংশগ্রহণ করতেন। এভাবে বিবেচনা করলে বলা যায়- ১৯৪৮-৪৯ কালপর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগ সংগঠনসূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত ছিলেন। মোগলটুলীতে বসবাস ছিল তার। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলের সংযুক্ত ছাত্র ছিলেন তিনি। তিনি সংযুক্ত ছিলেন স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে। তাঁর রোল নম্বর ছিল ১৬৬। গৌরবের বিষয় হলো বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুজ্জ্বল ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর নাম।
বঙ্গবন্ধু সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র হলেও বেশির ভাগ সময় আড্ডা দিতেন ফজলুল হক মুসলিম হলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে তিনি অধিকাংশ সময় কাটাতেন ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে। ১৯৪৪ সাল থেকে এই বাড়িতেই শামসুল হক, কামরুদ্দিন, তাজউদ্দীন প্রমুখ নেতার আনাগোনা ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালের শেষভাগে ঢাকায় এসে এই নেতাদের সঙ্গে যুক্ত হন। বাড়িটির নাম ছিল পার্টি হাউজ। পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এখান থেকেই শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু যুব আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি ছাত্র-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্র নেতাদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন। এরপর ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ তিনি। এ কারণে তাঁকে কারাবরণও করতে হয়। কারাগার থেকে বের হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ তরুণ নেতৃবৃন্দ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলে আন্দোলনকে বেগবান বিস্তার করেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ সালে আইন বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে দাবি-দাওয়া নিয়ে অসন্তোস চলছিল। কর্মচারীদের মাসিক বেতন ছিল নগণ্য। তাঁদের থাকার জন্য কোনো বাসস্থান ছিল না।
১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ থেকে কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করেন। কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ৩ মার্চ ক্লাস বর্জন করে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে ৫ মার্চ পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘটের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে বেলা ১২টায় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বলা হয়, কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া কর্তৃপক্ষ যত দিন মেনে না নেবে, ততদিন সহনুভূতিসূচক ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।
ছাত্রনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু কর্মচারীদের আন্দোলনকে শুরু থেকেই সমর্থন করে আসছিলেন।

প্রাদেশিক সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আন্দোলন ভন্ডুল করার জন্য ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ। ৬ জনকে ৪ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৫ জনকে আবাসিক হল থেকে বহিষ্কার করা হয়। একজনকে ১০ টাকা জরিমানা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৫ জনকে ১৫ টাকা করে জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া তাঁদের মুচলেকা দিতে বলা হয়। অনাদায়ে ছাত্রত্ব বাতিল। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্বান্তের প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ২০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে হরতাল ও অবস্থান ধর্মঘট ডাকা হয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তার হন। গ্রেপ্তার অবস্থায় তাঁকে ছাত্রত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য জরিমানা ও মুচলেকা দিতে বলা হয়। তিনি মুচলেকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন।

পরবর্তী সময় নিজ যোগ্যতায় শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রনেতা থেকে জাতীয় নেতায় পরিণত হন। জাতীয় নেতা হয়ে গেলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়নি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব গণতান্ত্রিক ও যৌক্তিক আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল।

শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়ায় পাকিস্তান সরকার। তিনিসহ ৩৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফুঁসে ওঠে বাঙালি। তীব্র আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার নতিস্বীকার করে। মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য আসামিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বাঙালির প্রাণের বন্ধু। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)
লাখো জনতার সামনে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপধিতে ভূষিত করা হয়।
আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরে বাঙালির সামনে হাজির হয় ১৯৭১ সাল। বঙ্গবন্ধুর ডাকে এ দেশের মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরে আসেন।

১৯৭২ সালের ৬ মে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসেন। যে বিশ্ববিদ্যালয় তাকে বহিষ্কার করেছিল, সে বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি ফিরে এলেন। এবার ছাত্র হয়ে নয়, আচার্য হয়ে। কলাভবনের সামনে বটতলায় তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাঁকে ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ দেওয়া হয়। সংবর্ধনা সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর সামনে তাঁর ছাত্রত্ব বাতিলের আদেশের কপি ছিঁড়ে ফেলা হয়। স্বাধীনতার পর দেশে খাদ্য সংকট চলছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলে এক বেলা ভাত ও এক বেলা রুটি দেওয়ার সিদ্বান্ত নেয়। কিছুদিন পর ছাত্ররা দুই বেলা ভাতের দাবিতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুজাফফর আহমেদ চৌধুরীকে ঘেরাও করে। বঙ্গবন্ধু প্রটোকল ছাড়াই উপাচার্যের বাসভবনে চলে আসেন। দুই বেলা ভাতের ব্যবস্থার আশ্বাস দেন তিনি। ছাত্ররা ঘেরাও প্রত্যাহার করে নেয়।
২০ জুলাই ১৯৭২ কিছু শিক্ষার্থী বিনা অটোপাসের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ কিছু শিক্ষককে অবরোধ করে রাখে। বঙ্গবন্ধুর কাছে এই সংবাদ পৌঁছালে তিনি নিজেই ছুটে আসেন ক্যাম্পাসে। না, অধ্যাপক মোজাফফরের মতো বঙ্গবন্ধু পুলিশ ডেকে এনে ছাত্রদের গ্রেফতার করাননি। তিনি এলেন, শিক্ষার্থীদের বোঝালেন। কেন তারা অটোপ্রমোশন চাওয়ার মতো অন্যায় দাবি তুলেছেন— তা নিয়ে ভর্ৎসনা করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্ত্বশাসন দেন বঙ্গবন্ধু। জারি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে এসেছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য তাঁকে আমন্ত্রণ জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আমন্ত্রণটি সাদরে গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু। তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাষ্ট্রপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর।
বঙ্গবন্ধুকে বরণ করার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জাতির জনক আসবেন বলে সাজে পুরো ক্যাম্পাস। সবার মাঝে উৎসবের ভাব। বঙ্গবন্ধুর আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে একদল বিপদগামী সেনা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বাঙালি চিরতরে হারায় তাদের মহান নেতাকে। থমকে যায় ইতিহাস।
২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে সিন্ডিকেট সভায় বঙ্গবন্ধুর ছাত্রত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার মহান সন্তান বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি নানাভাবে ধরে রেখেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে তাঁর জন্য একটি চেয়ার তৈরি করা হয়েছিল। সেই চেয়ারটি যত্ন করে রেখে দেওয়া হয়েছে। সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি মানপত্র দেওয়ার কথা ছিল। মানপত্রটি ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেওয়া হয়।

১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালে হলটির নাম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান করা হয়। ১৯৯৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ স্মরণে ২০১৮ সালে রোকেয়া হলে ৭ মার্চ ভবন উদ্বোধন হয়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু টাওয়ার। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্য বঙ্গবন্ধু ছিলেন অন্তঃপ্রাণ। বঙ্গবন্ধুর কেবল শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের জন্যও ছিলেন সমানে সমান। ১৯৪৮ সালের মার্চে ন্যায্য দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের করা আন্দোলনেও তার ভূমিকা ছিল অনন্য। কর্মচারীরা বেতন-ভাতা বাড়ানর দাবিতে ধর্মঘট ডাকলে সংহতি জানিয়ে ছাত্রলীগ তাদের পাশে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু তখন ছাত্রলীগের প্রাণভোমরা। এই ঘটনায় ২৭ জন ছাত্রনেতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ক্ষোভের শিকার হন। বঙ্গবন্ধুও ছিলেন ওই ২৭ জনের একজন। বিশ্ববিদ্যালয় জানায়, তাদের প্রত্যেককেই দিতে হবে ১৫ টাকা করে জরিমানা। ন্যায্য আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে জরিমানা দেওয়ার লোক বঙ্গবন্ধু নন। কর্তপক্ষের চাওয়া অনুযায়ী, ক্ষমা চাইলে শাস্তি মওকুফ হতো; বঙ্গবন্ধু সেটাও চাননি।

সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন ড. মোয়াজ্জেম হোসেন। সবাইকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু চলে গেলেন ভিসির বাসভবনে। আন্দোলন চালিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। তবে পুলিশ ডেকে আন্দোলনরত সবাইকে গ্রেফতার করিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান উপাচার্য ড. মোয়াজ্জেম। এবার বন্ডে সই করে কারামুক্তির সুযোগ আসে। শাস্তিপ্রাপ্ত সকলেই একে একে বন্ডে সই করে কারামুক্ত হয়েছিলেন। একমাত্র মানুষ, যিনি এই সুযোগটুকুও গ্রাহ্য করেননি, তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ফলস্বরূপ ১৯৪৯ সালের ২৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বহিষ্কার করে।
স্বাধীন হওয়ার প্রায় চল্লিশ বছর পরও এই বহিষ্কারাদেশ বহাল ছিল। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতির উপর জারি করা এই বহিষ্কারাদেশ বাতিল করতে দেশ স্বাধীনের পরও সময় নেওয়া হয় চার দশক। শেষমেশ ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধুর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়। তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থী হিসাবে গণ্য করে ওই বছর ১৪ আগস্টের সিন্ডিকেট সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশের ইতিহাসের ঐতিহাসিক তিনটি মুহূর্ত—১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মহান বিজয় এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন— সবকটির জন্ম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, এই রেসকোর্স ময়দানে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে অসংখ্য বই লেখা হয়েছে, বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেছেন। হয়েছে অসংখ্য গবেষণাও। তবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩ এর অধীনে ১৮তম সংবিধি সংযোজনের মধ্য দিয়ে ঢাবিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর পিস অ্যান্ড লিবার্টি’ নামে স্বতন্ত্র একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এটি প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রস্তাব উপস্থাপন করেন সিনেট সদস্য মনজুরুল আহসান বুলবুল।
বঙ্গবন্ধুর জীবন, দর্শন ও তার অনন্য অবদান এবং নেতৃত্বের উপর উচ্চতর গবেষণা ও চর্চা, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, প্রত্নতত্ত্ব, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ভূগোল, সঙ্গীত, শিল্পকলা, আইন ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ে উচ্চতর গবেষণা পরিচালনার পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নের জন্য অ্যাকাডেমিক মিউজিয়াম, সংগ্রহশালা, পরীক্ষাগার, কর্মশিবির স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসংখ্য ভাবনা ছিল। ১৯৭৩ সালে রাষ্ট্রপতির ১১ নম্বর আদেশের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। কেবল বঙ্গবন্ধুই নন; শিক্ষাজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তার পরিবারের আরও অনেকেই। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। পুত্রবধূ সুলতানা কামালও ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্রী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাও ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর বহু স্মৃতি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে এসে পা রাখবার প্রতীক্ষা এক মুহূর্তের ব্যবধানে অসীম হয়েছিল সেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। সেদিন দিনের বেলায় সমগ্র ঢাকা শহর ছিল গুমোট। শহরের বুকে এমন এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড যে ঘটে গেল— সেদিন সকালবেলায়ও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারেনি ঢাকাবাসী। এই অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে চলেছে প্রতিবাদী সংকলন বের করার তোড়জোড়। গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল আজিজের ১০২ নম্বর কক্ষে করা পরিকল্পনা অনুযায়ী ছড়া আর কবিতায় সাজানো সংকলনটির নাম ছিল ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’। এই সংকলনটির এককভাবে কোনো সম্পাদক ছিল না। এটি ছিল যৌথ একটি উদ্যোগ। তবে পুরো কর্মযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গণিত বিভাগের সেই আবদুল আজিজ। সংকলনটি প্রকাশের পরিকল্পনা, লেখা সংগ্রহ, ছাপাখানা নির্ধারণ, মুদ্রণব্যয় জোগাড়, প্রচ্ছদ নির্মাণ, বাঁধাই ও বিতরণের ক্ষেত্রে সামনে থেকে কাজ করেছিলেন আবদুল আজিজ। এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে ছিলেন বাংলার রাখাল রাজা। 


Comments

Popular posts from this blog

আসুন মানবিক আচরন করি

সাজ্জাদুর রহমান আতিকী সাহেব  নিজেস্ব প্রতীকি ছবি আল হাজ্ব হযরত মাওলানা সাজ্জাদুর রহমান আতিকী সাহেবের Facebook States থেকে আজকে নেওয়া হয়েছে! তিনি তাঁর Facebook States এ আজকে নিন্মক্ত কথাগুলো ব্যক্ত করেন! আজঃ ০৫ জুন,২০২০ রোজঃ শুক্রবার খলিফার হাট নিউজ fbKhalifarHatNewsOfficial     তিনি বলেনঃ  যে,  বেশি দিন হয়নি,গোটা বিশ্বই 'মানবতা বিরোধী অপরাধ' নিয়ে যথেচ্ছ চিৎকার চেঁচামেচি করেছিল!★কিন্তু আজ? 'করোনা'র রোগী ও করোনায় মৃত লাশের সাথে দেশে দেশে পরিবার,সমাজ যে অমানবিক আচরণ করছে! এটা কি মানবতা বিরোধী অপরাধ নয়? এই নিষ্ঠুরতার বিচার করবে কে?         ♦এ অবস্হাটা নিঃসন্দেহে আল্লাহপাকের জবাব! আপনজনদের প্রতি এই নিষ্ঠুরতার বিচারও হয়তো হাশরের দিন আল্লাহপাক করবেন! আমরা হয়তো বলবো-- নিজেদের বাঁচার জন্য এছাড়া আমাদের কোন উপায় ছিলনা! এ জবাব গৃহিত হবে কিনা? তা আখিরাতের মহা বিচারপতিই ভালো জানেন।।        ♦আসুন! আল্লাহ'কে ভয় করি এবং তাঁরই উপর পূর্ণ নির্ভর করে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ও মৃত লাশের সাথে মানবিক আচরনে নিজেদরকে উজাড় করি।।   ...

বাজারের অবস্থা

ভোগান্তিতে পড়ছে মানুষ      নিজেস্ব ছবি   রোড়ের মধ্যে ৩ ফিট গভীর গর্তে পরিনত, যান বাহন চলাচলে অসুবিধা, কাদায় ভরা রাস্তা!     নোয়াখালী সদর পশ্চিমে এক নামে পরিচিত খলিফার হাট বাজারের কথা সবাই জানেন! এই বাজারে প্রতিদিন ভিবিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজারমানুষ আসে! এছাড়াও প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ির যাত্রা হয়ে থাকে, এই খলিফার হাট বাজার দিয়ে! বিগত কয়েকদিন পূর্বে বাজারের প্রদান সড়কের কাজ করায়, বাজারের ভিতর দিয়ে সকল গাড়ি যাতায়াত করায় বাজারে এবং স্কুলরোড়ের অনেক ক্ষতি হয়!   খলিফার হাট স্কুল রোড এর ছবি এই রোড় দিয়ে প্রতিদিন পাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ, উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রায় ১০ হাজরের ও বেশি মানুষ যাতায়ত করে থাকেন! কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এখন রোড়টার এমন করুন অবস্থা হয়ছে যাতে করে অনেক গাড়ি, মানুষের ও ক্ষতি স্বাদিত হয়েছে বলে অনেকই মন্তব্য করেন!      খলিফার হাট বাজারের ছবি মাননীয় এমপি, নোয়াখালী মানুষের নয়নের মনি, জনাবঃ একরামুল করিম চৌধুরীর (নগদ চৌধুরী)  নিকট আকুল আবেদ,  সদর পশ্চিমে খলিফার হাট বাজারের এই রাস্তাটা মেরামতের জন্য আপনার এ...

অনিয়মের কারনে ৭ শিক্ষককে অব্যাহতি

  পরীক্ষা কেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনায় হল সুপার  অধ্যক্ষ দেলোয়ারসহ ৭ শিক্ষককে অব্যাহতি  রাসেদ বিল্লাহ চিশতিঃ নোয়াখালী সদর উপজেলায় চলমান এসএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রে  নোয়ান্নই ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে দায়িত্বের অবহেলা, নানান অনিয়মে জড়িত থাকার দায়ে হল সুপার  খলিফারহাট উচ্চ বিদ্যালয় প্রধানসহ মোট ৭ শিক্ষককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্র সচিব মো. টিপু সুলতান।  মঙ্গলবার (৯ মে) সাধারণ গণিত বিষয়ের পরীক্ষা চলাকালে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারগন নোয়াখালী সদর উপজেলার নোয়ান্নই ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে পরিদর্শনকালে হল সুপার ও খলিফার হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. দেলওয়ার হোসেন ও তার এক সহকারী শিক্ষক এসএসসি পরিক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনে চরমভাবে অবহেলা ও নানান অনিয়ম পরিলক্ষিত হওয়ায় তাদেরকে দায়িত্ব পালন থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।   অন্যদের মধ্যে নোয়ান্নই ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ২জন, করমুল্যাহ  উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ২ ...